দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা ও বাংলাদেশ

ইকবাল আজিজ
এশিয়ার মানচিত্রে দক্ষিণ এশিয়া একটি আলাদা ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বহুকাল আগে থেকে। মোগল আমলে কিংবা তারও অনেক আগে বৈদিক যুগ থেকে অসংখ্য রাজ্যে বিভক্ত ছিল এ অঞ্চল। অসংখ্য জাতিসত্তা, অসংখ্য ভাষা এবং হিন্দুধর্মের পাশাপাশি কিছু আঞ্চলিক লোকধর্ম_এই ছিল বৈদিক ভারতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এরপর শানত্মি ও অহিংসার বাণী নিয়ে বৌদ্ধধর্ম আবির্ভূত হয়েছে ভারত ভূখণ্ডে হিমালয়ের নিম্নাঞ্চল ঘেঁষে। একের পর এক বিদেশীরা দল বেঁধে এসেছে, তারা ধীরে ধীরে মিশে গেছে মূলধারার সঙ্গে। সবশেষে এসেছে মুসলমানরা; ভারতবর্ষে পাঠান-মুঘল শাসন দিল্লিকেন্দ্রিক সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে একটি সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করেছে। সম্রাট আকবরের সময় 'আসমুদ্র হিমাচল' ছিল এ সাম্রাজ্য। পাঠান-মুঘল শাসকরা কালক্রমে এ দেশেরই মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন; তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন প্রকৃত অর্থেই 'হিন্দুস্তানী।' পরে অবশ্য ইংরেজ ঔপনিবেশিকরা বিশাল ভারত উপমহাদেশকে একটি অভিন্ন শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় এনেছিল; ধর্ম, ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সত্ত্বেও একটি অভিন্ন 'ভারতীয় বোধ' গড়ে উঠেছিল বস্তুত ইংরেজ আমলে। এই বিশাল ভূখণ্ডে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন অতীতে ছিল, এখনও আছে; কিন্তু সবকিছু মিলে গঙ্গা-যমুনা-সিন্ধু যেন সুদূর ঝরনাধ্বনির মতো কল কল স্বরে 'ভারত জয়গাথার' কথা ঘোষণা করে। এত বিচ্ছিন্নতা ও বৈরিতা সত্ত্বেও এই মৈত্রীর সুর এক বৃহৎ আশাবাদ হয়ে আজও আমাদের হৃদয়ে ধ্বনিত হয়। ১৯৪৭ সালে দৰিণ এশিয়ায় ইংরেজ উপনিবেশবাদের সূর্য অসত্ম গেছে; ভাষা, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ভিন্নতার ধারক হয়ে ৮টি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করেছে এ অঞ্চলে। বহু সংঘর্ষ ও বহু বিরোধের পরও তারা এক হয়ে গঠন করেছে দৰিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা বা সার্ক।
১৯৮৫ সালে দৰিণ এশিয়ার সাতটি রাষ্ট্রকে নিয়ে দৰিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা 'সার্ক' গঠিত হয়েছিল। এই সংগঠনের অভু্যদয়ের পেছনে বাংলাদেশের একটি নিজস্ব উদ্যোগের ইতিহাস রয়েছে; পরে অবশ্য এই উপমহাদেশের প্রতিটি রাষ্ট্র এই সংগঠনের বিশাল সম্ভাবনাকে স্বীকার করে নিয়েছে। বাসত্মবিকই সার্ককে ভিত্তি করে ভিসামুক্ত কল্যাণকামী 'দৰিণ এশীয় ইউনিয়ন' গঠিত হলে বিশ্বের এ অঞ্চলে নিঃসন্দেহে একটি নীরব মহাবিপস্নব সম্পন্ন হবে। কিন্তু সার্ককে কেন্দ্র করে যতটুকু আশা করা গিয়েছিল, তার লৰ্যমাত্রার দশ শতাংশও অর্জিত হয়নি। এর কারণ হিসেবে ভারতসহ দৰিণ এশিয়ার আরও দু'একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রের এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তাকে শনাক্ত করা যায়। এর ফলে যেন হতে গিয়েও অনেক কিছু হলো না; সার্ক এখনও পর্যনত্ম এ অঞ্চলে কেবলমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল। অথচ একটু গভীরভাবে ভাবলে দেখা যাবে সার্কের সম্ভাবনা অসীম; এই সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের প্রায় ১৫৫ কোটি লোকের জন্য অবস্থার আমূল পরিবর্তনের এক অবিস্মরণীয় সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে এই সংগঠনের পরিপূর্ণ বাসত্মবায়নের মাধ্যমে দৰিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ উপকৃত হতে পারত সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের সরকার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও রাজনৈতিক দলগুলো কি এ বিষয়ে সচেতন? সার্ককে শক্তিশালী ও উপযোগী করার বিষয়ে নিজ স্বার্থে বাংলাদেশের অনেক কিছু করার আছে। আফগানিসত্মানের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সার্কের সদস্য সংখ্যা বেড়ে ৮-এ দাঁড়িয়েছে। আফগানিসত্মানের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সার্ক বাসত্মবিকই মানবিক, সাংস্কৃতিক ও আত্মিক দিক দিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। এখন দরকার এ সংগঠনের সকল সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো। সার্কের সাফল্যের মধ্যেই এর বাধাগুলো অপসারণ করতে হবে।
আফগানিসত্মান, বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও পাকিসত্মানের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ঐক্য ও সদিচ্ছা দরকার সবার আগে। প্রথমেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজের কয়েকটি ফ্রন্ট শনাক্ত করা দরকার। দারিদ্র্য ও সন্ত্রাস দূর করতে আটটি দেশই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারে। এ ৰেত্রে ভিসামুক্ত 'দৰিণ এশীয় ইউনিয়ন' গঠনের টার্গেট নিয়ে কাজ করার কোন বিকল্প নেই; ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদলে দৰিণ এশীয় ইউনিয়ন বা 'ভারতীয় ইউনিয়ন' গঠিত হলে এ অঞ্চলের প্রতিটি মানুষের মধ্যে অবাধ চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সার্কভুক্ত ৮টি দেশই তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রৰা করেই এই 'ভিসামুক্ত দৰিণ এশীয় ইউনিয়ন' কিংবা 'ভারতীয় ইউনিয়ন' গঠন করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় এ অঞ্চলে মানুষের চলাচল ও স্থানানত্মরের সুযোগ অনেক বৃদ্ধি পাবে; ৮টি দেশের যে কোন মানুষ তেমন কোন বাধা ছাড়াই অন্য দেশে গিয়ে চাকরি লাভের সুযোগ পাবে। তবে সার্ককে সফল করতে এ অঞ্চলের বৃহত্তম শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। ভারত যদি সার্কভুক্ত অন্য সাতটি রাষ্ট্রকে পরিত্যাগ করে একা আত্মউন্নয়নে নিমগ্ন হয়; তবে অন্য রাষ্ট্রগুলো পিছিয়ে যাবে স্থবিরতার অন্ধকারে। তাই ভারতের লৰ্য হওয়া উচিত সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। ভিসামুক্ত 'দৰিণ এশীয় ইউনিয়ন' গঠিত হলে বাংলাদেশসহ অন্য রাষ্ট্রগুলো যেমন উপকৃত হবে; তেমনই ভারতও উপকৃত হবে। বলা যায়, ভারতই দৰিণ এশীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হবে। সুতরাং সম্ভাব্য 'দৰিণ এশীয় ইউনিয়ন' নিয়ে ভারতের কোন দুশ্চিনত্মা বা আশঙ্কার কারণ আছে বলে মনে হয় না। সেই সঙ্গে ভারতের 'চিরশত্রম্ন' পাকিসত্মানকেও একবিংশ শতাব্দীর বাসত্মবতাকে অনুধাবন করতে হবে। এখন কারও দিক থেকে কারও মুখ ফিরিয়ে রাখার অবকাশ নেই। ভারত ও আফগানিসত্মানের সহায়তা ছাড়া পাকিসত্মান কখনই তার নিজ দেশের সন্ত্রাসীদের নিমর্ূল করতে সৰম হবে না।
এ কথা সত্য যে, স্বাধীনতা ও দেশভাগের রক্তাক্ত স্মৃতি উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহের দেয়াল গড়ে তুলেছে। এখন এই দেয়াল ভাঙ্গার সময় এসেছে। আর কতকাল নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ করা? নিজেদের প্রয়োজনে দৰিণ এশিয়ায় কাঁটাতারের সীমানত্মকে মৈত্রীর সীমানত্মে রূপানত্মরিত করতে হবে। বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি থাকলে আর কোন কিশোরী ফেলানীর লাশ ভারতীয় সীমানত্মে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলবে না। মানুষকে সম্মান করতে শিখতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে যেভাবে অভিন্ন মুদ্রা 'ইউরো' চালু হয়েছে, ঠিক একইভাবে সার্ক দেশগুলোতে অভিন্ন 'সার্ক' মুদ্রা চালু হওয়ার পথে বাধা কোথায়? ভারত ও পাকিসত্মান কি রাজি হবে না দৰিণ এশিয়ায় অভিন্ন মুদ্রা চালু করতে? অথচ অভিন্ন 'সার্ক' মুদ্রা চালু হলে এ অঞ্চলে প্রতিটি মানুষই লাভবান হবেন। ভিসামুক্ত দৰিণ এশিয়া গঠিত হলে এ অঞ্চলের প্রতিটি সাধারণ মানুষ সপরিবারে দৰিণ এশিয়ার অন্য দেশে সফর করতে পারবেন; তখন দেশগুলোর মধ্যে ব্যক্তিপর্যায়ে নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে। তেমনই দৰিণ এশিয়ায় অবাধ বাণিজ্য চালু হলে উপকৃত হবেন এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ।
একইভাবে অবাধ দৰিণ এশীয় যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। ইউরোপে যেমন লন্ডন থেকে ইউরো টানেল হয়ে প্যারিস কিংবা রোম পর্যনত্ম ট্রেনে যাওয়া যায়; অথবা প্যারিস থেকে ইসত্মাম্বুল পর্যনত্ম রয়েছে আরামদায়ক ট্রেন সার্ভিস, তেমনই অবাধ রেল ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে দৰিণ এশিয়ায়। শুধু সদিচ্ছা ও আনত্মরিকতার প্রয়োজন। ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে রেলযাত্রা শুরম্ন করে কলকাতা, দিলস্নী, অমৃতসর ও লাহোর হয়ে পেশোওয়ার যাওয়া কি সম্ভব হবে? ইতোমধ্যে দিলস্নীতে সার্ক বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত হয়েছে। একইভাবে গঠিত হতে পারে সার্ক ব্যাংক এবং সার্ক টেলিভিশন।
দৰিণ এশীয় ইউনিয়ন গঠিত হলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা জোরদার হবে। হয়ত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা চায় না, ভিসামুক্ত 'দৰিণ এশীয় ইউনিয়ন' গড়ে উঠুক। কারণ তারা জানে ভিসামুক্ত 'দৰিণ এশীয় ইউনিয়ন' বাসত্মবায়িত হলে তা হবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন। বাংলাদেশকে নিজ স্বার্থেই 'সার্ক'কে আরও সফল ও কার্যকর করার লৰ্যে কাজ করতে হবে। 'দৰিণ এশীয় ইউনিয়ন' গঠিত হলে বাঙালী ও বাংলা ভাষার মর্যাদা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে সারাবিশ্বে বাঙালীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিও জোরদার হবে
তথ্যসূত্রঃ দৈনিক জ়নকন্ঠ ০৬/০৪/২০১১